যে বই পড়লামঃ জুবোফ্স্কি বুলভার- মশিউল আলম | পাঠ প্রতিক্রিয়া | বুক রিভিউ
বইয়ের নামঃ জুবোফ্স্কি বুলভার
লেখকঃ মশিউল আলম
প্রকাশনীঃ প্রথমা প্রকাশন
মুদ্রিত মুল্যঃ ১১০/=
আমি নস্টালজিয়া এডিকটেড পার্সন। নস্টালজিয়া সংক্রান্ত যেকোন লেখা আমার ভালো লাগে। এসব লেখা আমার অন্তত বাহিরের খরায় এক পশলা বৃষ্টির মত।
জুবোফ্স্কি বুলভার বইটি তেমনি একটি বই। এর প্রধান চরিত্রের সাম্প্রতিক ঘটা ঘটনার মাঝে চরম নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার অদ্ভুত বেদনাময় যাত্রার বর্নণা।
অনেকদিন পর কোন একটা বই হাতে নিয়ে একদম শেষ করে উঠলাম। এইরকম চমকপ্রদ ব্যাপার কালেভদ্রে ঘটে ইদানীং। ক্যাফেতে কফি খেতে খেতে বইটি হাতে নিয়েছিলাম, অর্ধেক পর্যন্ত ডুবে যাওয়ার পর ঘড়ি দেখে খেয়াল হল বাসায় যেতে হবে তাই ধার করে নিয়ে এসে বাসায় বসেই শেষ করেই এই পাঠ পতিক্রিয়া লিখতে বসলাম। অনেক দিন পর কিছু পড়ে লিখতেও ইচ্ছে হল।
একজন লেখকের সার্থকথা বোধহয় এখানেই। এদিক দিয়ে মশিউল আলম সফল। আমি এর আগে তাঁর কোন বই পড়িনি। ম্যাগাজিন বা পত্রিকায় এক-দুইটি লেখা হয়ত পড়েছি। ঠিক মনে নেই। কিন্তু এই বইটি পড়ে আমার মনে হচ্ছে, উনি খুবই ভালো লেখেন। উনার বই গুলা আমার পড়া উচিত। উনার বর্নণা অনেক সাবলীল। বয়ে যাওয়া নদীর মত। কোথাও আটকায় না।
একটা প্যারা তুলে ধরে উদাহারণ দিচ্ছি-
“……ফাল্গুনে আশোকমঞ্জরি-সুবাসিত সকালে ফুলের সাজি হাতে বাড়ি বাড়ি ঘোরা, প্রথম বৃষ্টির পর মাটির সোঁদা গন্ধ, বৈশাখের ছায়াঘন দিন, ‘ঈশানের পুঞ্জমেঘ অন্ধবেগে ধেয়ে চলে আসে বাধাবন্ধনহারা’; রাতভর হাওয়ায় মাতলামি, ভোরে আম কুড়ানোর ধুম, বর্ষার এগিয়ে আসা ঘোলা জলে অবিরাম সাঁতার, রথের মেলায় সেই আশ্চর্য বাঁশির সুর, বাউলের অবিশ্রান্ত একতারা শুনে শুনে কাঁথার ওমে ঘুমিয়ে পড়া, শরতের কাকচক্ষু বিল থেকে শাপলা তোলা, নৌকা থেকে জলতলে আগাছার বন আর রুপোলি মাছের ঝাঁকের দিকে অপলক চেয়ে থাকা, সন্ধ্যায় রঙিন মেঘমালা নিয়ে রাজ্যের ভাবনা, ধানের শিষের আশ্চর্য সুঘ্রাণ, হেমন্তের সোনালি মাঠ, রাতে টিনের চালের শিশিরের শব্দ, ধান মাড়াইয়ে গরুর লেজ ধরে অবিরাম ঘোরা, পৌষসংক্রান্তির আগের দিন পিঠার লোভে মায়ের আঁচল ধরে উনুনের পাশে রাত জাগা, বড়দের চোখ এড়িয়ে শীতের রোদে খড়ের গাদায় শুয়ে রোমাঞ্চ-রহস্য লহরি পড়া, বহুদূর আকাশে উড়ন্ত চিল-শকুন দেখে মুক্তবিহঙ্গ হওয়ার সাধ, বাজার থেকে তুলতুলে হাঁসের ছানা কিনে বাড়ি ফেরা, তাদের লালন আর প্রথম পাড়া ডিম তুলে আনা রোমাঞ্চ, খানাখন্দ সেচে মাছ ধরে কাদায় মাখামাখি, বারোয়ারি উৎসবে পঙ্তিভোজন আর অকারণ পুলকে দিনমান ঘোরাফেরা…”
পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল মশিউল আলম আমার ছেলেবেলা নিয়ে লিখেছেন, আমি সব কিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। মাটির সোঁদা গন্ধ, বর্ষার গান, টিনের চালে শিশিরের শব্দ…আহ! অদ্ভুত এক ভালোলাগা যেন ঘিরে ধরেছিলো। এ এক অন্য অনুভুতি!
এরকম বর্ননা বইয়ের পরতে পরতে চরিত্রের ফ্ল্যাশব্যাকে বর্তমান আর অতীতের মাঝে মেলবন্ধন গড়ে দিচ্ছিল। বইটি সুখপাঠ্য হয়ে উঠার পেছনে লেখকের এই লেখনী শক্তি প্রশংসার দাবি রাখে।
বইয়ের কিছু কিছু কথা খুব ভালো লেগেছে, কোট করছি-
“তাঁর মা বলতেনঃ সুখী হল সেই জন, যে অঋনী ও অপ্রবাসী।”
“চন্দ্রকান্ত কবিরাজ মুখে লম্বা দাড়ি
ঔষুধের ডিবি লৈয়া বেড়াইন বাড়ি বাড়ি।
পান-তামাক দিলে তিনি কিছু নাহি খাইন
সুন্দরী রমনী দেখলে আড়নয়নে চাইন।।”
“কাঁঠালগাছে দেখছি দুটো হলদে পাখির ছানা
মায়ের মুখে খাচ্ছে আধার নাড়িয়ে দুটি দানা।”
“এখন সবই সম্ভবঃ মানুষের সিভিক সেন্স লোপ পেয়ে যাচ্ছে, কাজকর্মে মনো্যোগ কমে যাচ্ছে, যন্ত্রপাতিতে জং ধরছে, রাস্তাঘাটে ময়লা-আবর্জনা জমে উঠছে…থিংস আর ফলিং অ্যাপার্ট…।”
“ক্রাপোৎকিন নাকি একবার লেনিনকে জিগ্যেস করেছিলেন, ‘সমাজতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা কী?’
লেনিন জবাবে বলেছিলেন, ‘মানুষ। মানুষই সবচেয়ে বড় সমস্যা। সামাজিক ও বৈষয়িক পরিবেশ যত তাড়াতাড়ি বদলানো যায়, মানুষকে মোটেই তেমন বদলানো যায় না। মানুষ বদলায় খুব ধীরে।”
“তা ছাড়া তিনি মনে করতেন ধনতান্ত্রিক সমাজের বড় শিক্ষক ধনতন্ত্র নিজেই। শিক্ষকেরা সেখানে হাতিয়ার মাত্র। সত্যিকার মানবিক শিক্ষা সেখানে অসম্ভব। শোষণকে, অস্তিত্বের অসম লড়াইকে ন্যায়ের রঙিন মুখোশ পরানোই ধনতান্ত্রিক সমাজে শিক্ষকদের কাজ।”
“প্রাচুর্যের পিছনে ছুটতে গিয়ে মানুষ যে তার সভ্যতাকেই বিনাশের কিনারায় নিয়ে যাবে, তা তিনি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন। প্রাচুর্যের লালসায় মানুষ প্রকৃতিকে শোষণ করতে করতে ফতুর করে ফেলবে, এই গ্রহে শ্বাসের সবটুকু বাতাস নিঃশেষ হয়ে যাবে…।”
“মা বললেন, ‘জীবাত্মা আলোর পথ ধরে আপন তারায় পৌঁছায়ঃ যেথা হতে আসিয়াছি সেথা যাব ভাসি…’ ”
সাবলীল লেখনীতে সুখপাঠ্যের বাইরেও রাশিয়া নিয়ে আগ্রহী ছিলাম বলেই কি বইটি তাড়াতাড়ি পড়ে শেষ করতে পেরেছি? এই পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখতে আগ্রহী হয়েছি? মনে হয়! যাদের রাশিয়া নিয়ে আগ্রহ তাদের জন্য বইয়ের ফ্ল্যাপে বইটি নিয়ে সারমর্মটুকু তুলে ধরলাম–
“জুবোফ্স্কি বুলভার একটি সড়কের নাম। সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কো শহরের সেই সড়কের ধারে একসময় ছিল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অনুবাদপ্রতিষ্ঠান প্রগ্রতি প্রকাশন। সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বই তারা পৃথিবীর প্রায় ষাটটি ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করত। সেই প্রগ্রতি প্রকাশনে কাজ নিয়ে বাংলাদেশ থেকে গিয়েছিলেন সৌমেন রায়। দেড় দশকের বেশি সময় ধরে তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছেন অর্ধশতাধিক বই। তারপর একদিন বন্ধ হয়ে গেল প্রগ্রতির সব কর্মকোলাহল। সেই স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙের কাহিনি নিয়ে এ বই।”
বইটি পড়া থাকলে আপনার অনুভুতি কি ছিল? বইটি পড়লে পড়ার পর কেমন লেগেছে? কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না!
ফ্যাক্টঃ লেখক হায়াৎ মামুদও এই মস্কোর প্রগ্রতিতে অনুবাদের কাজ করেছেন। ঢাকার খালেদ চৌধুরীও। এই বইয়ের দেওয়া তথ্যে জানা হল। বইয়ের লেখক মশিউল আলমও মস্কো থেকে সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর পাশ করেছিলেন।
অনেকদিন পর কোন বই পড়ে ভালো লাগল, এতই ভালো যে সাগ্রহে পাঠ পতিক্রিয়াও লিখলাম। নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিলাম। বাহবা নিশাত!
বিঃদ্রঃ প্রকাশনী প্রথমা নিয়ে কিছু কথা বলার প্রয়োজন মনে করছি। তাদের প্রোডাকশনের প্রথম বই পড়লাম। বইয়ের কোয়ালিটি আসলেই ভালো। কাগজের কোয়ালিটি খুব ভালো। পড়তে আরাম। সর্বোপরি এই দামে ভালো একটি বই বলা যায়।
পড়ুন নিশাত শাহরিয়ারের অন্যান্য লেখাঃ
- আমি | কবিতা
- টাকা দিয়ে মোটিভেশনাল সেমিনার এটেন্ড করা মানেই ফাউল? ধান্দাবাজি? | বাঁকা চোখে
- বইয়ের পাতায়, বইয়ের ঘ্রানে……ও আমার সোনালি দিন!
- শেরি | উপন্যাস | প্রথম পর্ব
- আমার লাইব্রেরি | বইয়ের তালিকা
- বিরামচিহ্ন | কবিতা
- মধ্যরাতের পঙতিমালা 💔💔💔 | অনু কবিতা
- এবং “বিয়ে”
- ওরা রোদ্দুর হতে চেয়েছিল | কবিতা
- আমার এই আঙিনায় তোমার পায়ের ছাপ কখনো পড়বে না! | কবিতা
- যে বই পড়লামঃ জুবোফ্স্কি বুলভার- মশিউল আলম | পাঠ প্রতিক্রিয়া | বুক রিভিউ
- হেই ফেলিসিয়া! | কবিতা
- পপুলার হওয়া আর বিখ্যাত হওয়া দুইটা দুই জিনিস | উক্তি ১
- ফিলিস্তিনিদের জন্য হ্যাশট্যাগ কতটা কার্যকরী?
- ইন্ট্রোভার্ট লিডারশীপ, ফ্যামিলি ম্যান সুপারম্যান, ফ্রি প্যালেস্টাইন | নিশনামা ডাইজেস্ট ০১
- ভূমিকম্প, গলফারদের ধৈর্য্য, সিলিকন ভ্যালী, লায়োনেল মেসি | নিশনামা ডাইজেস্ট ০২
- ইস্যুময় ফেসবুক, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ও ইসরো | নিশনামা ডাইজেস্ট ০৩
- এসো বেদুইন হই, জব লাইফ, সম্পূর্না ও লোকি | নিশনামা ডাইজেস্ট ০৪
- লকডাউন, ওয়ার্ডপ্রেস ডিল, ক্রিয়েটিভিটিরও দাম আছে! | নিশনামা ডাইজেস্ট ০৫
- ট্র্যাজেডি, জাপানের বাচ্চারা ও আত্নবিশ্বাসী নারী | নিশনামা ডাইজেস্ট ০৬