|

প্রথম রক্তদানের অনুভূতি!

রক্তদানের প্রথম ইচ্ছেটা জাগ্রত হয় ২০০৭ সালে। তখন সবে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে কলেজে ভর্তি হয়েছি। পত্রপত্রিকায় বাঁধনকে নিয়ে লেখা পড়তাম আর অনুপ্রানিত হতাম। বাঁধন রক্তদানে এমন একটি সংগঠন যাকে আজকের এই রক্তদানে ট্রেন্ড তৈরির পথিকৃৎ হিসেবে মানা যায়।

তবে ঐ সময় ছেলেপুলেদের মাঝে এখনকার মত রক্তদান নিয়ে উৎসাহ এত সিরিয়াস পর্যায়ে ছিল না। কারন তখন যে ফেসবুকের মত সহজলভ্য মাধ্যম ছিল না দরকারি রক্তের খবর সবার মাঝে ছড়িয়ে দেবার জন্য কিংবা সচেতনতা বাড়ানোর! 
 

প্রথম রক্তদান – ১১-০৬-২০১৬ -সকাল ১১টা,সিলেট

মনের মাঝে তখন রক্তদানের ইচ্ছে প্রকট ছিল। কিন্তু সাহস দেওয়ার কেউ না পাওয়ায় নিজ থেকে এগুতে পারছিলাম না। সেই সময় এত ভীতু ছিলাম কি বলব সিরিঞ্জের গুতো আমি এত ভয় পেতাম যে আমাকে রক্ত পরীক্ষায় নিয়ে যাওয়াই সেই সময় অনেক কষ্টের ছিল। ছোট বেলা থেকে এই সুই সিরিঞ্জের একটা ভয় মনের মাঝে গোপনে ছিল। 
পরিবার থেকেও এই ভয় কাটানোর সাহস কার কাছ থেকে পাই নি। সবার মা বাবার চোখেই নিজের সন্তানকে সবাই না খাওয়া মরা বলেই ভাবেন। এর মাঝে যদি শুনে রক্তদানের কথা তাইলেই হইছে হায় হায় রব উঠবে। আমার মাও ছিলেন এমন। 
তারপরও বেশ কয়েকবার নিজে নিজে সাহস করেছিলাম কিন্তু আন্ডার ওয়েট এর বিড়ম্বনায় রক্তদানের সাহসিক মিশন সেই সময় আর সম্পন্ন করা হয় নি আমার!
এরপর সময় গড়িয়ে গেল। নিজের কাছের বন্ধুদের নিয়মিত রক্তদান করতে দেখে আস্তে আস্তে নিজেকে সাহস দিলাম যে রক্ত দিতেই হবে। বন্ধুদের সাথে যেতাম তাদের রক্তদানের সময়। সম্পূর্ন অচেনা অজানা একটা মানুষকে রক্ত দেওয়ার সময় তাদের চেহারায় সুখানুভূতি দেখতাম। যে মানুষটাকে রক্ত দিচ্ছে সেই মানুষটার কৃতজ্ঞতাভরা চোখের জল দেখে মনটা অদ্ভুত সুখে ভরে যেত। ঐ সময়ই নিজের কাছে ওয়াদা করেছিলাম ঠিক এই জিনিসটা আমিও অনুভব করতে চাই!
সবচেয়ে লজ্জাজনক একটা বিষয় ছিল যে আমি আমার নিজের ব্লাড গ্রুপই জানতাম না। হটাৎ করেই একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম, নাহ এভাবে আর কতদিন লজ্জায় থাকব। কোন কিছু প্ল্যান না করে হুট করে রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করলাম!
বি পজেটিভ! 
বাহ! রক্তের গ্রুপ দেখে প্রথমেই আমার মুখ দিয়ে এই শব্দটাই বের হয়েছিল! কারণ ব্যক্তিগত জীবনে আমি খুবই আশাবাদী একজন মানুষ। সব রকম পরিস্থিতিতেই পজিটিভ থাকতে চেষ্টা করি। জীবনের কঠিন সময়ে সব সময় নিজেকে বলি – Be Positive!সেই আমার এই ব্লাড গ্রুপ হবে না তো আর কার হবে! 😀  
এরপর রক্তদানের অপেক্ষার পালা। এর মাঝে বড় ভাই মুহাম্মদ আবু সালেহ আমার আগেই প্রথম রক্তদান করে ফেলেন। উনার সাথে একটা প্রতিযোগীতা ছিল, কে কার আগে রক্ত দিতে পারে। আমি খুব সৌভাগ্যবান যে সেই সময়টুকু আসতে দেরি হয় নি।
নিজের ফ্রেন্ড লিস্টের প্রায় সবাইকেই দেখতাম রক্তদান করতে। এর মাঝে অনেককেই দেখেছি রোজা রেখেও রক্তদান করতে। আমাদের অনেকের মাঝে একটা ভুল ধারণা আছে যে রোজা রেখে হয়ত রক্ত দেওয়া যায় না। এই ধারণাটুকু সম্পূর্ণ ভুল! আমি একজন সুস্থ সবল মানুষ হলে রোজা রেখেও রক্ত দিতে পারবেন। আমার নিজের একটা গোপন ইচ্ছা ছিল রোজা রেখে রক্তদান। 
আর আল্লাহর অশেষ কৃপায় সেটা আজ পুর্ণ হলো। আগের দিন সালেহ ভাই যখন জানালেন রক্ত দিতে পারব কিনা হ্যাঁ বলতে এক সেকেন্ডও দেরি করিনি। আজকে সকালে উঠে উনার ফোন পেয়েই রেডি হয়ে বিশ মিনিটের মধ্যে হাসপাতালে পৌছে গেলাম। 
অদ্ভূত একটা উত্তেজনা ভর করেছিল নিজের মাঝে। এর মাঝে সেহরী খেয়ে ঠিকঠাক মত ঘুম হয় নি। শুনে সালেহ ভাই একটু চিন্তায় পড়ে গেছিলেন যে রক্ত দিতে পারব কিনা। উনারে অভয় দিলাম, আজ আমি এখান থেকে রক্ত না দিয়ে যাচ্ছি না! চরম উত্তেজনায় কি না সুইয়ের ভয়ডর কিছুই ছিল না মনে। বেডে শুয়ে যখন রক্ত দিচ্ছিলাম অসাধারণ একটা সুখের অনুভূতি কাজ করছিল নিজের মনে! শেষমেশ আমি পারলাম!!! জীবনের প্রথম রক্তদান!!! <3 😀 
তবে সুখের অনুভূতি পাওয়ার আরো বাকি ছিল। স্রেফ কৌতূহল এর বশে কাকে রক্ত দিলাম সেই রোগীকে দেখতে গিয়েছিলাম রক্ত দেওয়ার পর। বেশ বয়স্ক এক বৃদ্ধ। ডায়াবেটিকস এর সমস্যায় হাসপাতালে ভর্তি। আমি যখন কাছে গিয়ে উনার ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করছিলাম উনি প্রায় কেঁদে ফেলছিলেন! উনার পরিবার তো পারলে আমাদের ইফতারের টাকা জোর করে দিয়ে দেন। অনেক কষ্টে উনাদের বুঝালাম যে রক্তদানের বিনিমিয়ে টাকা নেওয়াটাকে আমরা পাপ মানি।এর থেকে মন থেকে দোয়াই আমাদের কাছে অনেক কিছু! গ্রাম থেকে আসা এই পরিবারের বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে অচেনা একটা মানুষ রোজা রেখে তাদের ফ্রি রক্ত দিতে এসেছে! তাদের কাছে এটা নতুন কিছু ছিল। 
তাদের চোখমুখে যে কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসা ছিল সেটা দেখে আমি প্রথমবার অনুভব করলাম শুধু রক্তদান করার মাঝে যে সুখের অনুভূতি রক্তদানের পরে একটি অচেনা পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া দোয়া আর ভালোবাসার সুখানুভূতির সাথে আর কোন কিছুর তুলনা চলে না! <3
সেই প্রথমবার বুঝলাম, আমার সার্কেলের ছোট ভাই লোকমান, মাহফুজ, অভিজিৎ কিংবা ফ্রেন্ডলিস্টের নজরুল ভাইয়ার কেন নিঃস্বার্থ ভাবে অন্যের জন্য রক্তের ডোনার খুঁজে দিতে দিনরাত এক করে ফেলে। যারা জীবনে একবার হলেও রক্ত দিয়েছে তারা এর কারণ বুঝতে পারবে। এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মত না!
এখন আমার নিজেরই আফসুস হয় কেন আমি আগে থেকে রক্তদান করলাম না। তবে আজকে মনে মনে একটা শপথ নিয়েছি যে যতদিন বেঁচে থাকব নিয়মিত রক্ত দিয়ে যাব এবং অন্য কেউ রক্ত দিতে উৎসাহ দিব। 
 
যারাই এই পোস্ট পড়ছেন, তাদের সবাইকেই বলব রক্তদানে নিজের কোন ক্ষতি হয় না। রক্তদানে অন্যরকম সুখের অনুভুতিও যেমন পাবেন তেমন একটা জীবন বাঁচানোয় নিজের আমলনামায় সওয়াবও যুক্ত হবে। একবার সাহস করে দিয়েই দেখুন না! কথা দিলাম, নিজেই বুঝতে পারবেন রক্তদানের আগে ও পরের পার্থক্য। 
বিঃদ্রঃ যারা প্রথমবার রক্ত দিবেন তাদের একটা ছোট্ট টিপস দিচ্ছি – প্রথমবার রক্তদানের আগে আগের দিন অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা পরিমিত ঘুমিয়ে নিবেন। শরীরে কোন স্ট্রেস নিবেন না।আজকে আমি এই ভুলটা করেছিলাম, ঠিক মত না ঘুমিয়ে রক্ত দিতে গিয়েছিলাম যার কারণে প্রেশার লো হয়ে গিয়েছিল। রক্ত দিয়ে অবশ্যই কিছুক্ষন শুয়ে থাকবেন। রোজার সময় ছাড়া হলে রক্তদানের পর জুস টাইপের কিছু খেতে পারেন।
নিজের রক্তদানের এত বড় অনুভূতি লেখার কোন প্ল্যান ছিল না কিন্তু না লিখে পারছিলাম না! এ এক অন্যরকম অনুভূতি! আমার এই পোস্ট পড়ে কেউ যদি প্রথমবারের মত রক্তদান করতে যায় তাহলে ধরে নিব আমার এই লেখার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। 
আসুন, রক্ত দিই, জীবন বাঁচাই! 🙂
নিশাত শাহরিয়ার,
১১-০৬-২০১৬/ শনিবার -সময় রাত ১১টা
 

রক্তের গ্রুপ নিয়ে কিছু মজার তথ্যঃ

রক্তের গ্রুপের বৈশিষ্ট্য..

» “o+” এই ব্লাড গ্রুপের মানুষেরা স্বচ্ছ দৃষ্টি সম্পন্ন, গভীর মনোযোগী, উচ্চাকাঙ্খী, স্বাস্থ্যবান, বাকপটু, বাস্তববাদী, রোমান্টিক এবং অত্যান্ত বুদ্ধিমান হয়ে থাকে..

» “O-” এই গ্রুপের মানুষেরা সাধারণত অন্যের মতামতকে গ্রাহ্যকরে না, সমাজে মর্যাদা বাড়াতে আগ্রহী, বড়লোকের সঙ্গপ্রিয় এবং বড় বেশি বাচাল..

» “A+” এই ব্লাডগ্রুপের মানুষেরা গোছগাছ প্রিয়, দক্ষ চাকুরে এবং খুঁতখুঁতে স্বভাবের হয়ে থাকে। এরা আত্নকেন্দ্রিক, সুবিচারক, শান্ত, নিয়মতান্ত্রিক, বিশস্ত, নিয়মানুবর্তী ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন..

» “A-” এই ব্লাড গ্রুপের মানুষেরা খুব খুঁতখুঁতে স্বভাবের এবং কিছুটা অমনোযোগী। কিন্তু অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে বেশি মনোযোগী। এদের অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার প্রবণতা বেশি। এদের আছে নিজেকে লুকানোর অভ্যাস এবং একঘেয়েমি জীবন..

» “B+” এই ব্লাড গ্রুপের মানুষেরা স্বাধীনচেতা, মেধাবী, নমনীয়, মনোযোগী, স্বাস্থ্যবান, সরল, দক্ষ, পরিকল্পনাবাদী, বাস্তববাদী, আবেগপ্রবণ এবং খুববেশি রোমান্টিক হয়ে থাকে..

» “B-” এই ব্লাড গ্রুপের মানুষেরা অসংযমী, অপরিনামদর্শী, দায়িত্বহীন, অলস, স্বার্থপর, অগোছালো, অবিবেচক এবং স্বার্থান্বেষী হয়ে থাকে..

» “AB+” এই ব্লাড গ্রুপের মানুষেরা সাধারণত সুবিবেচক, বু্দ্ধি সম্পন্ন, হিসেবী, পরিকল্পনাবাদী, সৎ কৌশলী সংবেদনশীল, নিরেট এবং খুব চমৎকারসাংগঠনিক হয়ে থাকে..

» “AB-” এই ব্লাড গ্রুপের মানুষেরা দুর্বোধ্য, ক্ষমতাহীন, অন্যকে আঘাত করার প্রবণতা বেশি, এনার্জি স্বল্পতা, খুববেশি রক্ষনশীল ও বড় বেশি সংবেদনশীল হয়ে থাকেন..
 
আমার রক্তের গ্রুপ কিন্তু “B+”
আপনার???

Similar Posts

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.